ভাঙা রাস্তা মেরামত আর রাস্তার দু’পাশের আবর্জনা পরিস্কার করা ওদের কাজ। সেবামূলক এ কাজে শতনারী অংশ নিয়েছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। ওরা অনেকেই স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও অসচ্ছল কর্মহীন ছিল। এই কর্ম বদলে দিয়েছে এসব নারীর পারিবারিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান। সন্তানরা এখন ছুটছে স্কুল-কলেজে। স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে তাদের সংসারে। এ কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল (এলজিইডি) বিভাগের আরইআর, এমপি-৩ প্রজেক্ট। আজ বিশ^ গ্রামীণ নারী দিবস।
স্বামী পরিত্যাক্তা ফজিলা খাতুন। তার স্বামী রজব আলী দু’সন্তানকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। স্বামীর গৃহে ঠাঁই মিলেনি ফজিলার। সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছেন বাবার গৃহ রামগোপালপুর ইউনিয়নের নওয়াগাঁও গ্রামে। মেয়ের লেখাপড়ার খচর যোগাতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন টেক্সটাইলে কর্মরত। আর ছেলে শাওন মিয়া পড়ছে ৮ম শ্রেণিতে। তিনি জানান, রাস্তা ঠিককরা মহৎ কাজ। দু’পাশে জন্মনেয়া আগাছা-আবর্জনা পথচারীদের বিপদ ঢেকে আনে। এগুলো পরিস্কার করছি। বিনিময়ে প্রতিদিন ২৫০টাকার মধ্যে ১৭০টাকা নগদ পাই আর ৮০টাকা সঞ্চয় হচ্ছে। স্বামী নেই ভবানীপুর গ্রামের রোমেনা খাতুনে। তিনি জানান, তিনি (স্বামী) মারা গেছেন। এ কাজ পেয়ে, বেঁচে আছি।
এদিকে স্বামী আবু তালেবের উপার্জনে চলছে না জাহানারা আক্তারের ৪সন্তানের সংসার। তিনিও স্বামীকে সহযোগিতা করার জন্য এ প্রজেক্টে যোগ দিয়েছেন। তিনি জানান, আমরা মানুষের চলাচলের রাস্তা ভালা করি। আর এ টাকা দিয়ে ২ ছেলে আর ২ মেয়েকে লেখাপড়া করাই। বড় ছেলে কাউচার ৮ম শ্রেণিতে, সাগর মিয়া ৭ম শ্রেণি ও তাসলিম আক্তার ৫ম শ্রেণি ও তামান্না আক্তার ৩য় শ্রেণিতে পড়ছে। তিনি আরও জানান, কাচা-হাকা সড়কে পইলা (প্রথম) দুরল (ছোট ছিদ্র) হয়, পরে কুরল (বড় ছিদ্র) হয়, এরপরে রাস্তা ভাইঙ্গা-পইরা যায়। হেই সড়ক আমরা ঠিক রাহি। দুরল বন্ধ করে দেই… পরে রাস্তাও ঠিক থাকে।
অপরদিকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহী করেন নিতাই বর্মণ। এখন নদী আর বিল সব দখলে। তাই সংসার চালাতে পারছেন না। তাই তার স্ত্রী রেখা রানী বর্মণ সংসারের হাল ধরতে রাস্তার কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি জানান, আগে ঠিকমতো খেতে পারতাম না। এখন ২ মেয়ে আর ১ ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছি। ঘরটাও মেরামত করেছি।
অপরদিকে রিস্কাচালিয়ে সংসার চালান শহিদ মিয়া। বাড়ি রামগোপালপুর। ২সন্তানের লেখাপড়া চালাতে পারছিলাম। আমার স্ত্রী মুর্শিদা আক্তার এ কাজে যোগ দেয়ায় সংসারের অভাব-অনটন কমেছে। বড় মেয়ে জেসমিন আক্তার ৮ম শ্রেণিতে ও ছোট মেয়ে শারমিন আক্তার ১ম শ্রেণিতে পড়ে। বিশ^নাথপুরের গণেশ রাজবরের স্ত্রী কাঞ্চনী রাজবর জানান, এ কাজে যোগ দেয়ায় তিনি সুখের মুখ দেখেছেন। তার বড় ছেলে অনিক রাজবর ৯ম শ্রেণিতে, অপু রাজবর ৮ম শ্রেণিতে ও পলক রাজবর শিশু শ্রেণিতে পড়ে।
এদিকে দামগাঁওয়ের তপন বিশ^াসের স্ত্রী বিভারানী বিশ^াস জানায়, তার বড় ছেলে দীপ বিশ^াস ২য় শ্রেণিতে ও ছোট ছেলে প্রদীপ বিশ^াস শিশু শ্রেণিতে পড়ছে। বীরপশ্চিমপাড়া গ্রামের মৃত রইছ উদ্দিনের স্ত্রী আছিয়া খাতুন। স্বামী মারা যাওয়ার পর দু’সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন। এ কাজে যোগ দেয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছেন। রামগোপালপুরের সাথী আক্তার জানায়, তার স্বামী একজন দিনমজুর। সংসারের হাল ধরতে এ কাজে যোগ দিয়েছেন। তার বড় মেয়ে তামান্না আক্তার ৩য় শ্রেণিতে পড়ছে। আর ছোট মেয়ে রুমানা আক্তারের বয়স ৪বছর। বীর পশ্চিমপাড়া গ্রারেম স্বামী পরিত্যাক্ত শেফালী আক্তার জানান, তার স্বামী তপন মিয়া তাকে রেখে পালিয়েছে। এখন সড়কে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সংসারের হাল ধরেছেন।
উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের প্রকল্পের কমিউনিটি অর্গানাইজার মো. আকবর আলী জানান, এ প্রকল্প চলছে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে। প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ১০জন করে ১০০জন মহিলা এ প্রকল্পের অধিনে কাজ করছে। প্রকল্পের সুপারভাইজার মো. আব্দুল কাইয়ুম জানান, মহিলারা সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাজ করে। তারা রাস্তার সেবিকা। রাস্তা ঠিক রাখে, ছোট-খাট মেরামত করে মানুষের চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়। এলাকাবাসীও উপকৃত হচ্ছেন।
উপজেলা প্রকৌশলী আবু সালেহ মোহাম্মদ ওয়াহেদুল হক বলেন, একটি সড়ক ধসে গেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এলাকাবাসীও দুর্ভোগের শিকার হন। সড়কের সেবিকা বড় দুর্ঘটনার আগেই ওরা ছোট-ছোট গর্ত বা ভাঙা মেরামত করে। ফলে বড় দুর্ঘটনা থেকে রেহায় পাওয়া যায়।